মিথ্যা ও অহংকার নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ
নৈতিক অবক্ষয়ের মৌলিক কারণ:
শিক্ষার অভাব : শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ডহীন প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। যে জাতি যতবেশী শিক্ষিত সে জাতি ততবেশী উন্নত। এই জন্য মহান আল্লাহ বিশ্ব মানবতার জন্য
প্রথম যে নির্দেশনা দিয়েছেন তাহ’ল শিক্ষা’। তিনি বলেন, ‘পড়! তোমার প্রভুর
নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/১)। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরয’ (ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮, সনদ ছহীহ)। অতএব শিক্ষাই শক্তি, যার মাধ্যমে মানুষ সবকিছু জানতে পারে, বুঝতে পারে। প্রকৃতার্থে জ্ঞান অর্জনের দ্বারাই মানুষ সত্য-মিথ্যার, ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারে। পক্ষান্তরে যারা লিখতে, পড়তে জানে না তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল হয় এবং সত্য-মিথ্যা, ন্যায়- অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারে না। ফলে অপরাধ জগতের সাথে মিশে যায় এবং তাদের মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পায়। ইসলামী শিক্ষার অভাব : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সকল কালের সকল মানবের জন্য যুগোপযোগী একটি জীবন বিধান। কর্মহীন শিক্ষা যেমন অবাস্তব, ধর্মহীন শিক্ষাও তেমনই ফলদায়ক নয়।
কেবলমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথনির্দেশনা রয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকোচন করে কখনো নৈতিক শিক্ষা আশা
করা যায় না। সঠিক সময়ে সমাজের সকলকে ধর্মীয় শিক্ষা না দেয়া গেলে তাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি এবং নৈতিকতা ও নীতিবোধ জাগ্রত হ’তে পারে না। তাই ধর্মীয় শিক্ষার অভাবকে নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ বলা হয়। শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস : শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাসের উৎস একটু ভিন্ন ধরনের। এখানে সন্ত্রাস গড়ে উঠেছে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের কিছু বড় রাজনৈতিক দল তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষাঙ্গণগুলো কিছু ছাত্র ও অছাত্র দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা রয়েছে শূন্যের কোঠায়। শিক্ষাঙ্গণে বিভিন্ন আবাসিক হলে তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চলছে। অথচ উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতা হবে প্রকৃত শিক্ষার পাদপীঠ। কিন্তু সেগুলো এখন অনৈতিক শিক্ষার কারখানায় পরিণত হয়েছে। এ
টিও নৈতিক অবক্ষয়ের মৌলিক কারণসমূহের অন্যতম।
বেকারত্বের প্রভাব : বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের একটি উন্নয়শীল দরিদ্র দেশ। বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশের
মানুষের মাথাপিছু আয় ৩৭০ মার্কিন ডলার। বেকারত্বের কারণে এদেশের দারিদ্রের অভিশাপ দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার মত নৈতিক চাহিদাগুলো এখনো অপূর্ণাঙ্গ রয়েছে। বেকারত্বের কারণে গ্রাম ও শহরে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ যখন স্বাভাবিক ভাবে উপার্জন করতে পারে না তখন অপরাধের পথ বেছে নেয়। ফলে দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা ইত্যাদির মত অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জীবনসূচী বিশে্লষণ করলে দেখা যায় যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হল যৌবনকাল (১৬-৪০)। আর বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ যুবক। সত্তর দশক থেকে নববই-এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের যুবকদের জ্যামিতিক অবস্থান পর্যালোচনা করলে
দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালে ২৩.৯১%, ১৯৭৪ সালে ২০.০০%, ১৯৮১ সালে ২৪.৫০% এবং ১৯৯১ সালে ৩০.২০% যুবক ছিল, যাদের বয়স (১৬-৪০) বছরের মধ্যে। ২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী সে সময় যুবকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৬ মিলিয়ন এবং বেকার শিক্ষক্ষত যুবক ছিল ২২ মিলিয়ন। তাহ’লে ৫ বছর পর নিঃসন্দেহে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী বেকারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে (মাসিক আত-তাহরীক, ১৩ তম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর ২০০৯, পৃঃ ৩৫)। মাদকের ছড়াছড়ি : বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলীর মধ্যে মাদক অন্যতম। সংবাদপত্রের জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, নেশাগ্রস্থ ও অবৈধ চোরাচালান ব্যবসার সাথে জড়িত শতকরা নববই জন তরুণ-তরুণী, রাস্তাবাসী ও
কর্মসংস্থানহীন। শহরের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যুবক ৬০% এবং যুবতী ৫০%-এর বেশি
নেশাগ্রস্থ।
শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সর্বোচ্চ জ্ঞান কেন্দ্রের ছাত্রীরাও জড়িয়ে পড়েছে নেশার জগতে। উক্ত নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে গণিকাবৃত্তিকে। যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য এরচেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে? ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা অভিভাবকের কাছ থেকেপড়াশুনার খরচ বাবদ টাকা নিয়ে তা ব্যয় করছে নেশার দ্রব্য কিনতে। টাকা না পাওয়ার কারণে সুশিক্ষিত কন্যার হাতে বাবা-মায়ের হত্যার ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীতে। ব্যাংক কর্মকর্তার হাতে প্রাণ হারিছে স্ত্রী ও পুত্রসন্তান, স্ত্রী তার বন্ধুদের নিয়ে হত্যা করেছে ব্যবসায়ী স্বামীকে, চট্টগ্রামের রাউজানে স্ত্রী তার স্বামীকে খুন করে ঘরের মধ্যে লাশ পুঁতে রেখে নির্দয়তার প্রমাণ রেখেছে
এবং নেশাগ্রসত্ম কন্যা ঐশী ধারালো ব্লেডের আঘাতে হত্যা করেছে নিজের পিতা-মাতাকে।
মাদকতার এ রকম ভয়াবহ পরিণতি নৈতিকতাকে সত্যিই আজ হুমকির সম্মুখীন করেছে। পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির অনুকরণ : দেশের আপামর জনসাধারণ অপসংস্কৃতির অক্টোপাশে জড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে এখন সত্যের অমোঘ বাণী হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হ’ল ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালবাসা
দিবস। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, যা উদ্দম নৃত্য, সীমাহীন আনন্দ-উলস্নাস, তরুণ-তরুণীদের উষ্ণ আলীঙ্গন আর জমকালো নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অতি উৎসাহ-উদ্দীপনার
সাথে পালিত হয়। বস্ত্রহীন দেহ, অসুস্থ মানসিকতা আর যৌন উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ের দৃশ্যবলী বহিঃপ্রকাশ পরের দিন দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রথম
পৃষ্ঠায় ঘটা করে প্রকাশ করা হয়। যেন বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে এটাই দেশীয় সংস্কৃতি। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন দিবসীয়
সংস্কৃতি। মনে হয় যেন দিবসীয় সংস্কৃতির ভারে ছোট্ট-দ্বীপটি ভারাক্রান্ত। আছে ফ্যাশন ও বিজ্ঞাপন সংস্কৃতি, যা দেখে যুবচরিত্র ধ্বংস হচ্ছে, জড়িয়ে পড়ছে নানা অশ্লীলতায়। ফলে নৈতিকতার অবক্ষয় আরো প্রকট আকার ধারণ করছে।
প্রতিকার :
১. ধর্মীয় শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
দান।
২. অভিভাবকদের দায়িত্ব ও
সচেতনতা বৃদ্ধিসহ ছেলে-মেয়েদের
ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা।
৩. নারী-
পুরুষের সহশিক্ষা বন্ধ করা। প্রয়োজনে
শিফটিং পদ্ধতি চালু করা।
৪. মসজিদ ও
পঞ্চায়েতগুলোতে ধর্মীয় উপদেশ ও
সামাজিক শাসন বৃদ্ধি করা।
৫. ধর্ম ও
সমাজ বিরোধী মেলা ও অনুষ্ঠান বন্ধ করা।
৬. বিদেশী সংস্কৃতি বর্জন করা ও বিদেশী
মন্দ চ্যানেলগুলো বন্ধ করা।
৭. ইন্টারনেট
ও মোবাইলের মন্দ ব্যবহারের সুযোগগুলো
বন্ধ করা।
৮. সেই সাথে এমন শক্তিশালী
সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে, যা এ মন্দ
স্রোতকে বাধা দিবে এবং তার স্থলে সুস্থ স্রোত প্রবাহিত করবে। যতদ্রুত মুরববী, যুবক, সোনামণি ও মহিলাদের মধ্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের প্রচার ও প্রসার এবং মন্দ প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করা হবে, ততদ্রুত স্ব স্ব পরিবারে, সমাজে, ও রাষ্ট্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে ইনশাআল্লাহ। তাই আসুন! আমরা এ সমাজ ও দেশকে ভালবাসি। সকলেই মিলে নিজেদের ও ভবিষ্যত প্রজম্মের স্বার্থে একটি সুন্দর, সুখী, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী সমাজ ও দেশ গঠনে সম্মিলিত ভাবে আত্মনিয়োগ করি।
আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন
আমীন!!